ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার কৌশল সুন্দরবনে – (Fishing technique in the Sundarbans)
পাখি দিয়ে মাছ শিকার করা হয় সুদূর চীন এবং জাপানে। কিন্তু আমাদের দেশে? ভোঁদড় দিয়ে। ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করার এই পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক, বেশ পুরনো, প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য এটি। তবে কালের বিবর্তনে এ পদ্ধতি আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দরবনের নদীগুলোর এবং চিত্রা নদীর পাড়ের বেশ কিছু জেলে পরিবার এখনো ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকারের প্রথা টিকিয়ে রেখেছেন। নড়াইল জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ভোগরা, গোয়ালবাড়ি, রতডাঙ্গা, পঙ্কবিলাস আর গোয়ালবাড়িরসহ আরো কয়েকটি গ্রামে ভোঁদর জেলেরা বাস করছে।

আমাদের সুন্দরবনে যে ভোঁদড়টি পাওয়া যায় সেটি হলো ওরিয়েনটাল স্মল ক্লৌড ওটার। স্থানভেদে ছোট এ প্রাণীটি উদবিলাই, উদ, ধেরে, ধারিয়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ভোঁদড় সাধারণত লিপ্তপদী অর্থাৎ হাঁসের পায়ের মতো আঙ্গুলগুলো পাতলা পর্দা দিয়ে জোড়া লাগানো ফলে খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে এবং পানির উপরে মাথা না তুলে ডুব দিয়ে একবারে প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।
ভোঁদড় সমাজবদ্ধ জীব। বেশ ক্রীড়াপ্রবণও। বুদ্ধিমান এই প্রাণীগুলো বেশ বন্ধুবৎসল এবং সহজেই পোষ মানে। বেশিরভাগই বাস করে জলাশয়ের কিনারে, গর্তে। সুন্দরবন এলাকার জেলেরা এদেরকে পোষ মানিয়ে ও প্রশিক্ষন দিয়ে মাছ ধরার কাজে লাগায়। ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা প্রক্রিয়াটিও বেশ টেকনিকাল। দু’জন জেলে নৌকা চালায়। দু’জন জাল ধরে রাখে। জেলেদের এক একটা নৌকায় ৪/৫ টা ভোঁদড় থাকে (সুন্দরবন এলাকায় ভোঁদড়কে ধাইরা বলে)। তারপর ভোঁদড়কে জালের সঙ্গে পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। গলায় বাঁধা থাকে রশি।

জেলেদের প্রশিক্ষনলব্দ ভোঁদড় মাছকে তাড়িয়ে পানিতে পেতে রাখা জালের দিকে নিয়ে আসে। জেলেরা ভোঁদড়ের গায়ে রশি লাগিয়ে এর দিক নিয়ন্ত্রন করে। জাল থাকে ভোঁদড়ের পিছনে, জালের সামনে থাকা ভোঁদড়গুলি মাছকে জালের দিকে তাড়া করে, ঝোপঝাড়ে , কোটরে বা মাটির গর্তে লুকিয়ে থাকা মাছগুলি ভোঁদড়ের তাড়া খেয়ে বের হয়ে আসলে ভোঁদড় সেগুলিকে জালের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে, পরিনামে ধরা পরে জালে। এসব ভোঁদড় যত বেশি মাছ খায় তার চেয়ে বেশী মাছ ধরে। এভাবেই বছরের পর বছর সুন্দরবনের জেলেদেরকে মাছ ধরার কাজে সাহায্য করে আসছে এই ভোঁদড়।
আমরা চাই, বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী প্রাণীটি চিরতরে আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে না যাক। আমাদের শৈশবকালের মতন আমাদের শিশুরাও উচ্চস্বরে পড়ে যাক,
“আয়রে আয় টিয়ে
নায়ে ভর দিয়ে
না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে
তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে
ওরে ভোঁদড় ফিরে চা
খুকুর নাচন দেখে যা।”